সরকারি সম্পত্তি রক্ষা, রাজস্ব আদায়, ইজারা, রেকর্ড সংরক্ষণের জন্য এখন আর পুরোনো নথি খুঁজতে হয় না। জলমহালসহ ভূমি ইজারা গ্রহণের জন্য এখন আর মানুষকে ছুটতে হয় না এক অফিস থেকে অন্য অফিসে। খাসজমি খুঁজে বের করতে সরকারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও ছুটতে হচ্ছে না মাঠেঘাটে। কেননা, সরকারি ভূমি ব্যবস্থাপনার সব সেবা পাওয়া যাচ্ছে একটি অ্যাপসের মাধ্যমেই, আর ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনার এই অ্যাপসটি চালু করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। কয়েক বছর ধরে ওয়েবসাইটে অনলাইনের মাধ্যমে চলছে ভূমি সেবা কার্যক্রম। এতে কমে গেছে অনিয়ম। রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। অনলাইন এ সেবা আরো সহজ করতে তৈরি হয়েছে মোবাইল অ্যাপস। ফলে ডিজিটাল পদ্ধতির হাত ধরে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ ও হয়রানি থেকে মুক্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে ভূমি ব্যবস্থাপনা। আর ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনার সুফল পাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
কুমিল্লার সদর উপজেলার চম্পকনগর গ্রামের সাধারণ কৃষক আরব আলী। আট বছর আগে তিনি ৩২ শতক জমি কিনেছিলেন। সেই জমির নামপত্তন ছিল না। দূর্গাপুর ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে তিনি জানতে পারেন অনলাইনে নামপত্তনের আবেদন করা যায়। নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করেন তিনি। এরপর চারধাপ মোবাইল ফোনে ম্যাসেজের (এসএমএস) মাধ্যমে জানতে পারেন কাজের অগ্রগতি। সর্বশেষ এসএমএস পেয়ে উপজেলা ভূমি অফিস থেকে গ্রহণ করেন নামপত্তনের কাগজ। সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে একটি টাকাও দিতে হয়নি তাকে। ঘুষ, দুর্নীতি ও দালালের হয়রানি ছাড়াই ২৮ কর্মদিবসের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন হওয়ায় খুশি আরব আলী। তার মতো আরেক সেবাগ্রহীতা জেলার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি গ্রামের ফারুক আহমেদ। ক্রয়সূত্রে ১৪ শতক জমির মালিক। নামপত্তনের জন্য স্থানীয় ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে আবেদন করেন। তিনিও ভোগান্তি ছাড়াই সহজেই সেবা পেয়েছেন।
শুধু আরব আলী কিংবা ফারুক আহমেদ নয়, গত ২ বছরে কুমিল্লা সদর উপজেলায় অনলাইনে নামজারির সেবা পেয়েছেন ২৬ হাজার ২১১ জন। ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব এনেছে ই-নামজারি পদ্ধতি। ভরাসার ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, গ্রামে বসে ডিজিটাল সেন্টার থেকে ভূমি সেবা পাচ্ছেন সাধারণ নাগরিক। ভূমি অফিসে গেলে অচেনা লোকের কাছে সেবা নিতে হয়রানির শিকার হতে হতো। আমরা গ্রামবাসীর পরিচিতজন। আমাদের সেবামূল্য নির্ধারিত। সে কারণে বাড়তি টাকা গচ্চা দিতে হয় না। প্রতিটি অনলাইন আবেদন দ্রুততম সময়ের মধ্যে দাখিল করে দেয়া হয়। যে কারণে তাদের অর্থের সঙ্গে সময়ও বেঁচে যাচ্ছে। সদর ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা মোক্তার হোসেন জানান, ই-নামজারি চালু হওয়ায় সচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয়েছে।
কুমিল্লা সদর উপজেলা ভূমি অফিসের ভূমি-বিষয়ক ই-সার্ভিস সেন্টারের উদ্যোক্তা আমিন মাহমুদ বাবু বলেন, আগে সেবা নিতে আসা মানুষ দালালের খপ্পরে পড়ত। এখন সেই সুযোগ নেই। সেবাগ্রহীতার ভোগান্তি কমেছে। অর্থ ও সময়ও সাশ্রয় হচ্ছে। বুড়িচং উপজেলার ভূমি কর্মকর্তা মো. শাহআলম জানান, ২০১৯ সালের শেষের দিকে এই উপজেলায় অনলাইনে নামজারির আবেদন গ্রহণ ও নিষ্পত্তি কার্যক্রম ই-নামজারি চালু হওয়ার পর থেকে প্রত্যেক মাসে গড়ে এক হাজারের বেশি আবেদন পড়েছে। অনলাইনে আবেদন নেয়ায় মানুষের ভোগান্তি লাঘব হয়েছে। হাজার টাকার কাজ এখন ২৭ টাকায় হয়ে যাচ্ছে! অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. শাখাওয়াত হোসেন রুবেল বলেন, ই-নামজারি চালু করায় হাতের নাগালে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে সহজেই সাধারণ মানুষ আবেদন করছে। ভোগান্তি ছাড়াই পাচ্ছে সেবা। এতে দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে ভূমি অফিস। এতে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল হওয়ায় বেড়েছে গ্রাহক সেবার মান। কমেছে দুর্নীতি আর গ্রাহকদের ভোগান্তি। ভলিউম, রেকর্ডপত্র ও পর্চা, নকশাসহ প্রয়োজনীয় নথি এখন যথাযথভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে। যে পর্চা উত্তোলনে আগে মাসের পর মাস সময় লাগতো, তা উত্তোলনে এখন সময় লাগছে এক সপ্তাহ। আগে একটি পর্চা তুলতে এক হাজার থেকে পনেরশ’ টাকা লাগতো। সেখানে এখন মাত্র ২৭ টাকায় পর্চা ও নকশা উত্তোলন করা যাচ্ছে। এর জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ইনফরমেশন সেলে পর্চা বা নকশার জন্য নির্ধারিত সবুজ কাগজে ২৭ টাকা কোর্ট ফিসহ আবেদন করতে হয়। আবেদন করার পর উক্ত শাখা থেকে পর্চা উত্তোলনে সময় দেয়া হয় ৭ দিন।
জানা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমি সংস্কার বোর্ড ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম কর্তৃক পরিচালিত ই-মিউটেশন (নামপত্তন) সেবা চালু করা হয়। ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে নির্ধারিত দুই শ’ টাকা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। এরপর সেই অনলাইন আবেদন ও নথিপত্র চলে যায় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের প্রতিবেদনের জন্য। ইউনিয়ন ভূমি অফিসের প্রতিবেদন হয়ে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে চলে যায় শুনানির জন্য। শুনানি শেষে সরকার নির্ধারিত এক হাজার ১৫০ টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। প্রত্যেকটি ধাপেই সেবাগ্রহীতাকে টেলিটকের ১৬৩৪৫ নম্বর থেকে এসএমএস দেয়া হয়। শেষ ধাপে ই-নামজারির তথ্য নিশ্চিত করা হয়। সর্বোচ্চ ২৮ কার্যদিবসের মধ্যেই আবেদন নিষ্পত্তি হয়। এসএমএস পেয়ে আবেদনকারী উপজেলা ভূমি অফিস থেকে নামপত্তনের কাগজ সংগ্রহ করতে পারেন। এতে আগের মতো ঘাটে ঘাটে ঘুষ, দুর্নীতি ও দালালের দৌরাত্ম্যের শিকার হতে হচ্ছে না সেবাগ্রহীতাদের।
উল্লেখ্য, ভূমি এমন একটি মৌলিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবিকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসন, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও অন্যান্য উন্নয়নকর্মা-ের জন্য প্রতিনিয়ত জমির প্রয়োজন হচ্ছে। নদীগর্ভেও বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ জমি। এসব কারণে দেশে প্রতি বছর মোট জমির ১ শতাংশ বা প্রায় ৮২ হাজার হেক্টর জমি কমে যাচ্ছে। তাই দেশের চলমান উন্নয়ন কর্মকা-ের গতি সচল রাখতে ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল করতে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও সামরিক শাসনামলের পুরাতন ভূমি আইনসমূহ সংস্কারপূর্বক সেগুলোকে যুগোপযোগী করাসহ তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ ও উন্নয়ন চাহিদার প্রয়োজনে নতুন কিছু আইন প্রণয়ন করেছে। ভূমিসংক্রান্ত প্রতারণা ও নানাবিধ অপরাধ প্রতিরোধের জন্য ভূমিসংক্রান্ত অপরাধ আইন, কৃষিজমি সুরক্ষা ও পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ভূমি ব্যবহার আইন, হয়রানিমুক্তভাবে অনলাইনে জমির খাজনা প্রদানের জন্য ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ভূমির সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভূমি সংস্কার আইন ইত্যাদি নতুনভাবে প্রণয়ন করেছে। অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় জটিলতা নিরসনে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়াসহ ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ ও জনবান্ধব করার জন্য বিধিমালা করা হয়েছে।
ভূমি অফিসে হয়রানি ও কাজের দীর্ঘসূত্রিতার উল্লেখযোগ্য কারণ দালালের দৌরাত্ম্য, দলিলপত্রের জাল-জালিয়াতি এবং প্রচলিত এনালগ সেবা পদ্ধতি। এসব অনিয়ম দূর করার অন্যতম উপায় হচ্ছে সেবাসমূহের অটোমেশন। আর সে লক্ষ্যেই একটি উচ্চ মানসম্পন্ন ইন্টারঅপারেটেবল সফটওয়্যারের মাধ্যমে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমজাতীয় সেবার সঙ্গে সমন্বয় করে সব ধরনের ভূমিসেবাকে অটোমেশন করা হয়েছে।
এখন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকলে ঘরে বসেই অনলাইনে ই-নামজারির আবেদন করা যাচ্ছে। জমির মালিকানার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হচ্ছে খতিয়ান বা পর্চা, যা জমি ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তরের সময় প্রয়োজন হয়। রেকর্ডসমূহ অনেক পুরাতন ও জরাজীর্ণ হওয়ায় সেগুলো রেকর্ডরুমসমূহে সংরক্ষণ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সিএস রেকর্ড অনেক পুরাতন হওয়ায় এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যেগুলো আছে সেগুলো এত দুর্বল যে, ধরা বা নাড়াচাড়া করা যায় না। তাই প্রায় সাড়ে ৪ কোটি খতিয়ান ডিজিটাইজড করা হয়েছে। এখন নাগরিকগণ অনলাইনে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে তাদের জমির খতিয়ান দেখতে পারছেন এবং প্রয়োজনীয় ফি পরিশোধ সাপেক্ষে অনলাইনেই তা সংগ্রহ করতে পারছেন। অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা প্রদানও করতে পারছেন কোনো হয়রানি ছাড়াই।
(বাসস)
© স্বত্ত্বঃ ইঞ্জিনিয়ার্স ভয়েস: ২০১৭-২০২৪ --- “ইঞ্জিনিয়ার্স ভয়েস” এ প্রকাশিত/প্রচারিত যেকোন সংবাদ, আলোকচিত্র, অডিও বা ভিডিওচিত্র বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং নিষিদ্ধ।
Leave a Reply